
বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে সঠিকভাবে খাবার পানি বিশুদ্ধ করতে জানাটা এই মুহূর্তে সবথেকে বেশি জরুরি। কারন বন্যাদুর্গত এলাকায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো নিরাপদ খাবার পানির অভাব। বন্যার পানিতে ভেসে জীব-জন্তু, পশুপাখিসহ নানান ধরনের প্রাণী মারা গিয়ে পানির সাথে মিশে যায়। ফলে, বন্যার পানিতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ মিশে যায়, যা পানিকে ভয়াবহ ক্ষতিকারক করে তোলে। তাই চারিদিকে অথৈ পানি থাকলেও পান করার মতো এক ফোটা বিশুদ্ধ পানির ও অভাব দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে, পানি সঠিকভাবে বিশুদ্ধ করতে না পারলে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে। ফলে কলেরা, ডায়রিয়ার মতো নানান ভয়াবহ পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। তবে কিছু সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি জানা থাকলে, আপনি সহজেই খাবার পানি বিশুদ্ধ করতে পারবেন। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক পানির সঠিকভাবে বিশুদ্ধকরণের সেইসব গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে।
১. উবালানো বা ফুটানো (Boiling)
পানি বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাচীন পদ্ধতি হলো পানি ফুটানো। এটি প্রায় সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং পরজীবী ধ্বংস করতে কার্যকরী। এবং অনেক সহজ একটি প্রক্রিয়া ও বটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ৬০°ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৫-২৫ মিনিট ধরে পানি ফুটালে তা পান করার উপযোগী বিশুদ্ধ হবে অথবা ১০০°ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টগবগ করে ফোটার পর ১-৩ মিনিট পর্যন্ত ফুটিয়ে নিতে হবে। অতিরিক্ত সময় পানি ফোটানোর ফলে এর মধ্যে থাকা প্রয়োজনীয় উপাদানসহ অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। যেহেতু আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপমাত্রা মেপে পানি ফুটাতে পারিনা তাই নিচের উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় পানি ফুটিয়ে নিলে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবেন।
পদ্ধতি:
- পানির বড় পাত্রে পানি ঢালুন এবং গরম করতে থাকুন।
- পানি ফুটে উঠলে কমপক্ষে ৫-১০ মিনিট ফোটাতে থাকুন।
- পানি ঠান্ডা হলে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করুন।
ফুটানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানিতে থাকা সব ধরনের জীবাণু মারতে পারে, তবে এতে ময়লা, কাদা বা অন্যান্য বড় কণাগুলো থেকে যায়। এই কারণে, পানি ফোটানোর আগে বা পরে একটি কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতে পারেন। আর এভাবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুব সহজেই পানি বিশুদ্ধ করে নিতে পারেন।
২. ওয়াটার পিউরিফিকেশন ট্যাবলেটস (Water Purification Tablets)
বাজারে অনেক ধরনের ওয়াটার পিউরিফিকেশন ট্যাবলেটস বা পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেটস পাওয়া যায়, যা বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি বিশুদ্ধ করতে খুবই কার্যকর হতে পারে। এই ট্যাবলেটগুলো ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস ধ্বংস করতে পারে।
পদ্ধতি:
- প্রতি লিটার পানির জন্য একটি করে ট্যাবলেট ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ ৫ লিটার পানি হলে তার জন্য ৫ টি ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।
- ট্যাবলেট ভালোভাবে গলে যাওয়ার জন্য ৩০-৬০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
- পানি তারপর পান করার জন্য প্রস্তুত।
এই পদ্ধতিটি দ্রুত পানি বিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর।
৩. চারা/বালি ফিল্টার (Charcoal/Sand Filter)
বালি বা চারা ফিল্টার দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি খুব প্রাচীন এবং কার্যকর একটি পদ্ধতি। এটি সাধারণত দূষিত পানিকে পরিশোধন করে পানযোগ্য করে তোলে। এই পদ্ধতিতে বালি, কাঁকর, এবং কখনও কখনও কাঠকয়লার মতো প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধকরন হয়ে থাকে। নিচে এই পদ্ধতিটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:
পদ্ধতি:
- প্রথম ধাপ (কন্টেইনার প্রস্তুত করা): প্রথমে একটি পরিষ্কার পাত্র নিতে হবে। পাত্রের নীচে ছোট ছিদ্র থাকতে হবে যাতে পানি সঠিকভাবে নিঃসৃত হতে পারে।
- দ্বিতীয় ধাপ (কাঁকর স্তর): পাত্রের নিচের দিকে একটি কাঁকরের স্তর তৈরি করতে হবে। এটি পানি চলাচলের পথে বড় মাপের ময়লা ও কণাকে আটকাবে। কাঁকরের স্তর সাধারণত ১০-১৫ সেমি পুরু হতে হয়।
- তৃতীয় ধাপ (বালি স্তর): কাঁকরের ওপর একটি ঘন বালির স্তর বসাতে হবে। বালি ছোট মাপের কণাকে আটকে রাখবে এবং পানির সলিড দূষণকারী পদার্থগুলো ফিল্টার করবে। বালির স্তর সাধারণত ২০-২৫ সেমি পুরু হয়।
- চতুর্থ ধাপ (কাঠকয়লা স্তর): কাঠকয়লা ব্যবহার করা হলে, বালির ওপর এটি একটি পাতলা স্তর হিসেবে রাখতে হবে। এটি পানির রঙ ও গন্ধ কমাতে এবং অর্গানিক কেমিক্যাল ও ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করবে।
- পঞ্চম ধাপ (ফিল্টার করা): এখন পানি ফিল্টারটির উপরের অংশে ঢালা হয়, এবং পানি ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রতিটি স্তর পানি থেকে বিভিন্ন ধরণের দূষণকারী পদার্থকে অপসারণ করে।
৪. ব্লিচ বা ক্লোরিন (Bleach or Chlorine) ব্যবহার করুন
ব্লিচ বা ক্লোরিন একটি সহজলভ্য রাসায়নিক, যা পানি বিশুদ্ধ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পানিতে থাকা জীবাণু ধ্বংস করতে পারে। তাই বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরনের ক্ষেত্রে এটি একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে।
পদ্ধতি:
- প্রতি লিটার পানিতে ২-৪ ড্রপ ব্লিচ দিন।
- ব্লিচ ভালোভাবে মিশে যাওয়ার জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
- পানির গন্ধ কমাতে, এটি আরও ৩০ মিনিট খোলা বাতাসে রেখে দিন।
এটি ব্যবহার করার সময় অবশ্যই নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্লিচ ব্যবহার করতে হবে, বেশি মাত্রায় ব্যবহার করলে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই সতর্কতা মেইনটেইন করতে হবে অবশ্যই।
৫. সোলার ডিসইনফেকশন (Solar Disinfection)
সোলার ডিসইনফেকশন (Solar Disinfection) হলো পানি বিশুদ্ধকরনের একটি সহজ ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি, যেখানে সূর্যের আলো ব্যবহার করে পানির ভেতরে থাকা জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা হয়। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে যেহেতু নিরাপদ পানির ভয়াবহ অভাব দেখা দেয়, তাই যদি অন্য কোনো উপায় না থাকে, তাহলে সূর্যের আলো ব্যবহার করেও পানি বিশুদ্ধ করা যেতে পারে।
পদ্ধতি:
- পরিষ্কার বোতলে পানি ভরে নিন এবং বোতলকে সূর্যের আলোতে রাখুন।
- কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা সূর্যের তাপ পানিকে জীবাণুমুক্ত করবে।
এই পদ্ধতি সহজ হলেও, এটি অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে কম কার্যকর হতে পারে, তবে সঠিক পরিস্থিতিতে এটি একটি ভাল বিকল্প হতে পারে।
৬. ওয়াটার ফিল্টার পাম্প (Water Filter Pump)
ওয়াটার ফিল্টার পাম্প বিশেষত বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ খাবার পানির অভাব দেখা দেয়, কারণ পানি দূষিত হয়ে পড়ে এবং পানযোগ্য থাকে না। এই পরিস্থিতিতে ওয়াটার ফিল্টার পাম্প একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।
পদ্ধতি:
- ফিল্টার পাম্পে পানি ঢালুন।
- পাম্পের মাধ্যমে পানি ফিল্টার করুন এবং পরিশুদ্ধ পানি পান করুন।
উপসংহার
বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য নিরাপদ খাবার পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি। তবে যেকোনো পদ্ধতি ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকা এবং সঠিক নির্দেশনা মেনে চলা আবশ্যক, কারণ বিশুদ্ধ না করা পানি পান করলে রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। সঠিক পদ্ধতি জানা এবং তা প্রয়োগ করার মাধ্যমে বন্যার মতো কঠিন পরিস্থিতিতেও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব।

Hi, I’m Sadab Muntasir, a Digital Content & Video Creator. I’m here to share insights, tips, and strategies to help you grow. Let’s start your digital content journey together!
Leave a Reply